
বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা কারণ ও প্রতিকার।
বর্তমানে বিষণ্ণতা শব্দটি খুব বেশী শোনছি। কিশোর থেকে বৃদ্ধ মোট কথা সবাই বিষণ্ণতায় ভুগছে। তাই আজ আমরা কোরআন ও হাদিস থেকে বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব। ইনশা-আল্লাহ।
মানুষ যখন জীবনের মূল্য খুঁজে পায় না, তখন সে কি করবে কি না করবে সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণা থাকে না। তখন সে এমন কিছু কর্ম করার চিন্তা করতে থাকে যাতে করে তার থেকে মুক্তি পায়।
যেমন মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। একাকী থাকাটাকে ভালোবাসে। কিন্তু এগুলো করার পরও সে কোন রাস্তা পায় না। তাই সে হতাশ হয়ে পরে। এবং চিন্তা করতে থাকে এ জীবন আর রাখব না। যেমন বর্ণিত রয়েছে:
ইবনে-কাসীর রহ وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ এ আয়াতের ব্যক্ষায় বলেনঃ উল্লেখিত দেখা ও নিকটবর্তী হওয়ার অর্থ জিবরীলকে দেখা ও জিবরাঈলের নিকটবর্তী হওয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রথমবার আসল আকৃতিতে দেখেছিলেন এবং দ্বিতীয়বার মে’রাজের রাত্রিতে সিদরাতুল-মুন্তাহার নিকটে দেখেছিলেন।
যখন জিবরীল সূরা ইকরার প্রাথমিক আয়াতসমূহের প্রত্যাদেশ নিয়ে প্রথমবার আগমন করেছিলেন।
এরপর ওহীতে বিরতি ঘটে, যদ্দরুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
নিদারুণ উৎকণ্ঠা ও দুর্ভাবনার মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করার ধারণা বারবার তার মনে জাগ্রত হতে থাকে।
কিন্তু যখনই এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হত,
তখনই জিবরীল আলাইহিস সালাম দৃষ্টির অন্তরালে থেকে আওয়াজ দিতেনঃ হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি আল্লাহ তা’আলার সত্য নবী, আর আমি জিবরীল।
কোরআন বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা কারণ ও প্রতিকার নিয়ে কি বলে?
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ ۟
وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِکُمۡ رَحِیۡمًا
হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।
আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।
وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ এর অর্থ আত্মহত্যাও হতে পারে, যা মহাপাপ। আবার পাপ করাও হতে পারে, কেননা তাও ধ্বংসের কারণ। আবার কোন মুসলিমকে হত্যা করাও হতে পারে।
কারণ, সকল মুসলিম একটি দেহের মত। কাজেই কোন মুসলিমকে হত্যা করা মানেই নিজেকে হত্যা করা।
জীবনে যত ধরণের পেরেশানী বা হাতাশা আসুস না কেন যা সত্যিকারে সইতে পারার মত নয়।
এমন অবস্থায়ও নিজেকে হত্যা করার মত যগণ্য অপরাদ করা যাবে না।
কেননা এই একাকিত্ব, হতাশা তার জীবনের প্রতি ভালোবাসা ধ্বংস করে দেয়। এবং সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আর প্রকৃত পক্ষে একজন ঈমানদার কোনোদিন ডিপ্রেশনে ভুগে না। আত্মহত্যা করে না।
এ জন্য যে হাদিসে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কঠিন ভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ…عَنْ ثَابِتِ بْنِ الضَّحَّاكِ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ
مَنْ حَلَفَ بِمِلَّةٍ غَيْرِ الإِسْلاَمِ كَاذِبًا مُتَعَمِّدًا فَهُوَ كَمَا قَالَ
وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ عُذِّبَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ
মুসাদ্দাদ (রহঃ) … সাবিত ইবনু যাহহাক (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
যে ব্যাক্তি ইসলাম ব্যতিত অন্য কোন ধর্মের (অনুসারী হওয়ার) ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা হলফ করে সে যেমন বলল, তেমনই হবে
আর যে ব্যাক্তি কোন ধারালো লোহা দিয়ে আত্মহত্যা করে তাকে তা দিয়েই জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
উন্নত বিশ্বে নানা কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। উদ্বেগ হতাশা ও দুঃখ থেকে যেমন মানুষ আত্মহত্যা করে তেমনই দুনিয়ার সকল প্রাপ্তি পরিপূর্ণ হয়ে মানুষ যখন সুখের প্রতিও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে
তখন সে আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগে। দলে দলে আত্মহত্যার এ কাজটিকে জাপানিরা বলে হারিকিরি।
জীবনকে ভোগ করতে করতে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে যায় তখনও তার মন তৃপ্ত হয় না।
কারণ, মন এ পৃথিবীতে তৃপ্ত হওয়ার নয়। তাই তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
যদি তাদের মাঝে ঈমান ও আল্লাহর ভয় থাকত তাহলে কখন এ কাজ তারা করত না। হাদিসে আছে:
حَدَّثَنَا مُعَلَّى بْنُ أَسَدٍ…عَنْ ثَابِتِ بْنِ الضَّحَّاكِ، قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ مِلَّةِ الإِسْلاَمِ فَهْوَ كَمَا قَالَ ـ
قَالَ ـ وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ عُذِّبَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ، وَلَعْنُ الْمُؤْمِنِ كَقَتْلِهِ
وَمَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهْوَ كَقَتْلِهِ.
মুআল্লা ইবনু আসাদ (রহঃ) … সাবিত ইবনু যাহহাক (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
কোন ব্যাক্তি ইসলাম ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের কসম করলে সেটা ঐ রকমই হবে যে রকম সে বলল। তিনি (আরও বলেন)
কোন ব্যাক্তি যে কোন জিনিসের মাধ্যমে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনে তাকে ঐ জিনিস শাস্তি দেয়া হবে। কোন মুমিনকে লানত করা তার হত্যা তুল্য।
আবার কোন মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দেওয়াও তার হত্যা তুল্য।
মহান আল্লাহ বললেন: আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।
حَدَّثَنِي مُحَمَّدٌ… حَدَّثَنَا جُنْدُبُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، فِي هَذَا الْمَسْجِدِ
وَمَا نَسِينَا مُنْذُ حَدَّثَنَا، وَمَا نَخْشَى أَنْ يَكُونَ جُنْدُبٌ كَذَبَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ، فَجَزِعَ
فَأَخَذَ سِكِّينًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ، فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ
قَالَ اللَّهُ تَعَالَى بَادَرَنِي عَبْدِي بِنَفْسِهِ، حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ
মুহাম্মদ (রহঃ) … বলেন, জুনদুব ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) বসরার এর মসজিদে আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনা করেন।
সে দিন থেকে আমরা না হাদীস ভুলেছি না আশংকা করেছি যে, জুনদুব (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছেন।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে একজন লোক আঘাত পেয়েছিল তাতে কাতর হয়ে পড়েছিল।
এরপর সে একটি ছুরি হাতে নিল এবং তা দিয়ে সে তার হাতটি কেটে ফেলল। ফলে রক্ত আর বন্ধ হল না। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল।
মহান আল্লাহ বললেন, আমার বান্দাটি নিজেই প্রান দেয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করল (অর্থাৎ সে আত্মহত্যা করল)।
কাজেই, আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।
মানুষ মূলত জান্নাতে সৃষ্ট জীব। তার আত্মাটি পৃথিবীতে বহিরাগত। এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হয়।
তবে দেহটি যেহেতু তার মাটির তৈরি তাই পৃথিবীকে তার ভালো লাগে।
এ ভালোলাগা ও না লাগার সংঘাত সয়েই মানুষকে বাঁচতে হয়। পৃথিবীর বৈরিতা মোকাবিলা করার জন্য আল্লাহ মানুষকে হেদায়াতের পথ দান করেছেন।
যারা এ পথ অনুসরণ করে তারাই পারে সফলভাবে পৃথিবীর সকল বৈরিতা মোকাবিলা করতে।
এরপরও যদি হৃদয় শান্ত না হয় তাহলে এর একমাত্র ওষুধ আছে আল্লাহর জিকিরের মধ্যে।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমানদার তারা আল্লাহকে স্মরণ করে মনে শান্তি পায়।
উদ্বেগ, দুঃখ-দুশ্চিন্তা মোকাবিলার ওষুধ
মনে রেখ, আল্লাহর জিকিরের মধ্যেই আছে অন্তরের প্রশান্তি।’ প্রাত্যহিক উদ্বেগ, দুঃখ-দুশ্চিন্তা মোকাবিলার জন্য আল্লাহ অনেক ওষুধ দিয়েছেন। যেমন কোরআনে বর্ণিত রয়েছে:
وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ کَثِیۡرًا وَّ سَبِّحۡ بِالۡعَشِیِّ وَ الۡاِبۡکَارِ
আর তোমার রবকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যা তার তাসবীহ পাঠ কর’
আল্লাহ নির্ভরতা, ধৈর্য, সন্তুষ্টি, লোভহীনতা ও কৃতজ্ঞতাবোধ। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে ও পীর-মাশায়েখগণ মানুষকে এসব গুণ শিক্ষা দিয়েছেন।
হাদীসে এসেছে, হতাশা কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
আত্মহত্যা মহাপাপ। যে আত্মহত্যা করে তার পরকালীন শাস্তি অনন্তকাল সে নিজেকে হত্যা করতে থাকবে।
আর সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। যেমন হাদিসে এসেছে:
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ…عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
مَنَ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ فَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا
وَمَنْ شَرِبَ سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا
وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ..আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
যে ব্যাক্তি কোন ধারাল অস্ত্র দ্বারা আত্নহত্যা করবে, সে অস্ত্র তার হাতে থাকবে, জাহান্নামের মধ্যে সে অস্ত্র দ্বারা সে তার পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে।
আর যে ব্যাক্তি বিষপানে আত্নহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষ পান করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে।
এবং যে ব্যাক্তি নিজকে পাহাড় থেকে নিক্ষেপ করে আত্নহত্যা করবে, সে ব্যাক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নিচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পতিত হতে থাকবে, এভাবে সে ব্যাক্তি সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।
কোন জিনিষ মানুষকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে পারে?
আত্মহত্যা থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে একমাত্র তার ঈমান। যখন সে বোঝে যে আমার সকল অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ পাক জানেন। তিনি আমার বর্তমান বিপদ বা হতাশা সম্পর্কেও জানেন।
তার জানার বা ইচ্ছার বাইরে কিছু নেই। আমার উচিত সবর করা। বিপদ তিনিই দূর করবেন।
আমার মালিক আমি নই। নিজেকে হত্যা করাও অপর মানুষকে হত্যা করার সমান অপরাধ।
তাছাড়া আমি মৃত্যুর মধ্যে সমাধান খুঁজছি বটে, তবে এখানে সমাধান নেই। বরং আরও বড় বিপদ ও আযাবের মুখে আমি নিজেকে ঠেলে দিচ্ছি। যা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ আমার নেই।
এগুলো চিন্তা করে যদি সে সবর করতে পারে তাহরে সে সফলকাম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা কারণ ও প্রতিকার নিয়ে যে আলোচনা হল তা থেকে পূর্ণ উপকার নেওয়ার তাওফিক দান করুক। আমিন।