
কন্যাসন্তানের মা হওয়া অপরাধ ?
আমাদের সমাজের ব্যবহার দেখলে বুঝা যায় কন্যাসন্তানের মা হওয়া অপরাধ তাই এ বিষয়ে আজ কিছু লেখার ইচ্ছা করছি। সন্তান আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ট নেয়ামত ও শ্রেষ্ঠ উপহার।
চাই তা ছেলে হোক বা মেয়ে ইসলাম উভয়কেই আলাদা সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। কাউকে কারও থেকে ছোট করা হয়নি কিংবা অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়নি।
হাদিসে উল্লেখ হয়েছে:
:قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ…. أَنَّهُ، سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْمِنْبَرِ وَهُوَ يَقُولُ
فَإِنَّمَا ابْنَتِي بَضْعَةٌ مِنِّي يَرِيبُنِي مَا رَابَهَا وَيُؤْذِينِي مَا آذَاهَا
কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) … মিসওয়ার ইবনু মাখরামা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মিম্বরের উপর থেকে বলতে শুনেছেন….
আমার মেয়ে আমারই একটা অংশ। যা তাকে বিষন্ন করে, তা আমাকেও বিষন্ন করে, তাকে যা কষ্ট দেয়, আমাকেও তা কষ্ট দেয়।
কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো কোন মা যদি পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয় তবে সব দায় তার ঘাড়েই চাপে। অনেক পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে ইতিবাচক চোখে দেখা হয় না।
অনেকে আবার মেয়ে সন্তানের মায়ের ওপর নাখোশও হন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। যা আজকাল পত্র পত্রিকার প্রতি পৃষ্ঠাতে দেখা যায় তাকে উঠতে বসতে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।
জাহিলিয়্যাতের যুগে কন্যাসন্তানের মা হওয়া অপরাধ ছিল। কিন্তু বর্তমান ?
এটাত সে জাহিলিয়্যাতের যুগের ঘঠনা যে যুগে কন্যা সন্তানের পিতা হওয়া ছিল ভীষণ লজ্জার বিষয়। সমাজে তার মুখ দেখানোটাকে নিজের জন্য লজ্জা মনে করা হত।
এমনকি আপন কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে রাখতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা হতো না। তাইত হাদেসে এ বিষয় সম্পর্কে বলা হয়:
وَحَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ الْحَنْظَلِيُّ….مُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوقَ الأُمَّهَاتِ وَوَأْدَ الْبَنَاتِ
ইসহাক ইবনু ইবরাহীম হানযালী (রহঃ) ….. মুগীরাহ ইবনু শুবাহ হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়েদের অবাধ্য হওয়া, জীবন্ত কন্যা সন্তানকে মাটিতে পুঁতে ফেলা।
তাদের এই অবস্থা তুলে ধরে কোরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالأُنثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ
যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তারা মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। সুরা নাহল আয়াত : ৫৮
يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِن سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ
أَلاَ سَاء مَا يَحْكُمُونَ
তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে।
শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট। সুরা নাহল আয়াত : ৫৯
কোরআনের অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُواْ أَوْلاَدَهُمْ سَفَهًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
وَحَرَّمُواْ مَا رَزَقَهُمُ اللّهُ افْتِرَاء عَلَى اللّهِ
قَدْ ضَلُّواْ وَمَا كَانُواْ مُهْتَدِينَ
নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজ সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতাবশতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে
এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে।
নিশ্চিতই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি। সুরা আন’য়াম আয়াত : ১৪০
ইসলাম-পূর্ব জাহেলী বর্বরতার যুগের চিত্র।
এ ছিল ইসলাম-পূর্ব জাহেলী বর্বরতার যুগের চিত্র, যেখানে ছিল না কোন ধরণের শিক্ষা-দীক্ষা যা তাদেরকে সভ্য, ভদ্র ও সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
কিন্তু বর্তমান সময়! বর্তমান যুগ! এ তো শিক্ষা-দীক্ষার আধুনিক ও এক বিস্ময়ের যুগ! সভ্যতার যুগ! বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগ!
এরপরও এরা কেন পশুর মতো আচরণ? তবে কি সভ্য সমাজে বসবাসকারী মানুষ গুলো সে পশুর মত যাদের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন এভাবে:
أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ
إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا
আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে ?
তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মত; বরং আরও পথভ্রান্ত। সুরা ফুরকান আয়াত : ৪৪
কোরআনের অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيراً مِّنَ الْجِنِّ وَالإِنسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لاَّ يَفْقَهُونَ بِهَا
وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُونَ بِهَا أُوْلَـئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ
أُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না,
তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর।
তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ। সুরা আরাফ আয়াত : ১৭৯
তার স্থানে যদি আমি হতাম।
আপনারা কি কখনো বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে দেখেছেন, কন্যা সন্তান প্রসবের কারণে যে নারীর ওপর আমি বা আমরা যে অমানবিক নির্যাতন করছি,
তার স্থানে যদি আমি অথবা আমার কোনো বোন বা মেয়ে হতো এবং সে আমার বা আমাদের ওপর অনুরূপ নির্যাতন চালাত তাহলে কি আমি বা আমরা তা মেনে নিতাম?
এ ধরণের বিবেক-বুদ্ধিমান মানুষের তুলনায় ঐ দরিদ্র মহিলা অনেক ভাল যার আলোচনা হাদিসে এসেছে:
حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ….عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتْ دَخَلَتِ امْرَأَةٌ مَعَهَا ابْنَتَانِ لَهَا تَسْأَلُ
فَلَمْ تَجِدْ عِنْدِي شَيْئًا غَيْرَ تَمْرَةٍ فَأَعْطَيْتُهَا إِيَّاهَا، فَقَسَمَتْهَا بَيْنَ ابْنَتَيْهَا وَلَمْ تَأْكُلْ مِنْهَا
ثُمَّ قَامَتْ فَخَرَجَتْ، فَدَخَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَيْنَا، فَأَخْبَرْتُهُ فَقَالَ
مَنِ ابْتُلِيَ مِنْ هَذِهِ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ.
বিশর ইবনু মুহাম্মদ (রহঃ) … ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ভিখারিণী দু’টি শিশু কন্যা সংগে করে আমার নিকট এসে কিছু চাইল।
আমার নিকট একটি খেজুর ব্যতীত অন্য কিছু ছিলনা। আমি তাকে তা দিলাম। সে নিজে না খেয়ে খেজুরটি দু’ভাগ করে কন্যা দু’টিকে দিয়ে দিল।
এরপর ভিখারিণী বেরিয়ে চলে গেলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আসলেন। তাঁর নিকট ঘটনা বিবৃত করলে তিনি বললেনঃ
যাকে এরূপ কন্যা সন্তানের ব্যাপারে কোনরূপ পরীক্ষা করা হয় তবে সে কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে পর্দা হয়ে দাঁড়াবে।
ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই
সন্তান জন্ম দেয়া, না দেওয়া, কিংবা মেয়ের পরিবর্তে ছেলে বা ছেলের পরিবর্তে মেয়ে সন্তান প্রসব করার মাঝে কোন মায়ের কোনো ধরণের ক্ষমতা নেই।
এ বিষয়ে পূর্ণ এখতিয়ার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই।
কোরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاء يَهَبُ لِمَنْ يَشَاء إِنَاثًا
وَيَهَبُ لِمَن يَشَاء الذُّكُورَ
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা’আলারই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন যাকে ইচ্ছা কন্যা-সন্তান
এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। সুরা শূরা আয়াত : ৪৯
أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَن يَشَاء عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ
অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। সুরা শূরা আয়াত : ৫০
আল্লাহ তাআলার উপরোক্ত সুস্পষ্ট ঘোষণার পরও যদি কোনো হতভাগা মা জাতির উপর নির্যাতন করে এবং বর্বর আচরণ থেকে বিরত না থাকে তাহলে তাদের বলব
উপযুক্ত শাস্তি পেতে সেই দিনের অপেক্ষায় থাকুন।
আপনার এই জুলুম ও নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি পেতে সেই দিনের অপেক্ষায় থাকুন, যেদিন আপনার সকল ক্ষমতা ও অহঙ্কার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে তখন প্রতিটি জালিম চিৎকার করে বলতে থাকবে:
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ
أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُم مَّا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَن تَذَكَّرَ وَجَاءكُمُ النَّذِيرُ
فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِن نَّصِيرٍ
সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, বের করুন আমাদেরকে, আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা করব না।
আল্লাহ বলবেন আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দেইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল।
অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই। সুরা ফাতির আয়াত : ৩৭
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে উক্ত আলোচনা থেকে ভরপুর উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুক। আমিন।